উপজেলা নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই কঠিন বাস্তবতার মুখে পরছে ক্ষমতাশীন দল আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। দলের কেন্দ্র থেকে নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখার কথা বলা হলেও স্থানীয় বাস্তবতা এলাকা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। জেলা ও উপজেলার প্রভাবশালী নেতারা কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও অপ্রকাশ্যে পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন। বেশ কয়েকটি উপজেলায় প্রার্থী সংসদ সদস্যদের স্বজনেরা। তারা কেন্দ্রের নির্দেশনা উপেক্ষা করে প্রার্থী রয়ে গেছেন।
বিভিন্ন দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নৌকা না থাকায় এবার দলটির নেতা-কর্মীরা এখন আর একমুখী নির্বাচন করতে পারছেন না। ফলে নিজ নিজ নেতার পক্ষে বিভক্ত আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। দেশের কয়েকটি জায়গায় নির্বাচনের আগে বিচ্ছিন্নভাবে সংঘাতের খবরও পাওয়া গিয়েছে।
জানা গেছে, দলীয় প্রতীক ‘নৌকা’ বাদ দিয়ে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে প্রার্থী হতে দলের নেতাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় আওয়ামী লীগ। কেন্দ্র থেকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার না করতে মন্ত্রী, এমপিদের নির্দেশনাও দেয়া হয়। নির্বাচনে তাদের স্বজনদের প্রার্থী হতেও বারণ করা হয়।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন কেন্দ্র করে উপজেলা পর্যায়ে বিশেষ বর্ধিত সভা করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। এসব সভা থেকে ভোটে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করার ঘটনাও ঘটে। অপর দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ে যে সংঘাত ও সংঘর্ষ হয়েছেন তার একটি প্রভাব উপজেলা নির্বাচনেও পরতে পারে বলে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন এলাকার তৃণমূল নেতারা মনে করছেন।
দলের স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মূলত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয় রাজনৈতিক বাস্তবতা গুরুত্ব পাচ্ছে। কোন কোন এলাকায় কেন্দ্র থেকে স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। দল থেকে কাউকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া নৌকা প্রতীক কঠিন বাস্তবতায় রাখেনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্র। ফলে মাঠ পর্যায়ে যে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা বেশি এবং পরিচ্ছন্ন তাদের উঠে আসার সম্ভাবনা হলে অনেক জায়গায় ভোট ভাগ করতে স্থানীয় দলীয় একটি বলায় একাধিক প্রার্থীকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।
এ ছাড়া কেন্দ্রের নির্দেশনা উপেক্ষা করে এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন সংসদ সদস্য ও তাদের স্বজনেরা। এর ফলে নির্বাচনও এখন ক্ষমতা ও পেশা শক্তির প্রভাবমুক্ত হতে পারে নি।
সংসদ সদস্যদের স্বজনদের নির্বাচন প্রত্যাহার নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত শুক্রবার দলের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার এখনো সময় আছে। যে কোনো সময় প্রত্যাহার করতে পারে। শেষটা দেখেন। দলের নির্দেশ অমান্য হলে সময় মত ব্যবস্থা নেওয়া হবে– এমন কথা কিন্তু আমি বলেছি।
কাউকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে আওয়ামী লীগ বাধ্য করতে পারে কী না অপর এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, কোনটা করলে প্রশংসা করবেন? আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে সব সময় একটা উল্টা প্রশ্ন করতে অভ্যস্ত। আমাদের কৌশল নিয়ে আপনার কথা বলার দরকার নেই। নির্বাচন ঘিরে সিইসির সংঘাতের শঙ্কার বিষয়টি আওয়ামী লীগ কীভাবে দেখছে, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, সংঘাতের আশঙ্কা হয়ত করতে পারেন। সংঘাত যেন না হয়, সেটা দেখার জন্য আমাদের দায়িত্ব আছে, আমাদের প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।
স্থানীয় প্রতিনিধি জানিয়েছে, টাঙ্গাইলে মধুপুর উপজেলায় আওয়ামী লীগের ৩ নেতা নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে ওই এলাকার সংসদ সদস্য ও দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাকের অনুসারী হলেন ইয়াকুব আলী। বেশ কয়েকদিন আগে আগে ইয়াকুবের অনুসারীদের সঙ্গে দলের আরেক উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছরোয়ার আলম খান আবুর অনুসারীদের মধ্যে হামলার ঘটনা ঘটে। এর পর থেকে ওই এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছে।
ওই উপজেলায় আরেক প্রার্থী হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. মির ফরহাদুল আলম মনি। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, টাঙ্গাইলের আরেক উপজেলা ধনবাড়ী উপজেলায় আওয়ামী লীগেরই প্রার্থী সংখ্যা ৫ জন।
মধ্যের মধ্যে হারুনুর রশিদ হিরা ওই এলাকার সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের সমর্থিত বলে এলাকায় আলোচনা রয়েছে। ড.আব্দুর রাজ্জাকের খালাতো ভাই হারুনার রশীদ হিরা ও মামাতো ভাই মঞ্জুরুল ইসলাম তপন প্রার্থী হয়েছেন। যা এলাকায় বেশ উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এ ছাড়া নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন আব্দুল ওয়াদুদ, ওয়াহিদুজ্জামান ও সাবেক ছাত্র নেতা মেহেদী হাসান। বেশ কয়েকদিন আগে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনার রশীদ হিরার কর্মীদেরকে মারধর করে আহত করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনজুরুল ইসলাম তপনের লোকজন। স্থানীয় সংষদ সদস্য ড. রাজ্জাক তাঁর ভাইকে সমর্থন দিচ্ছেন এ নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েও ছিলেন।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী হয়েছেন মোট ৪ জন। যাদের মধ্যে স্থানীয় বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান অরুনাংশু দত্ত টিটু, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারুল ইসলাম রয়েছেন। এ ছাড়াও রয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক কামরুল হাসান খোকন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি রওশনুল হক তুষার।
ফলে উপজেলা আওয়ামী লীগের এখন চারভাগে বিভক্ত হয়ে পরেছে। তবে অরুনাংশু দত্ত টিটু ও মোশারুল ইসলামের মধ্যেই মূল লড়াই হতে পারে বলেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা
স্থানীয় সূত্র জানিেেছ, কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলা নির্বাচন চতুরমুখি লড়াই হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতা রহিম খান, বর্তমান চেয়ারম্যান বাবুল আক্তার, আল মাসুম মোরশেদ একে অপরে প্রতিদ্বদ্বিতা করছেন। সেখানকার পরিস্থিতি অনেকটা থমথমে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সূত্র জানিয়েছে, দলের সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের স্বজনেররা যাতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায় সে জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পরও তারা সরে যাচ্ছেন না। এ জন্য একাধিকবার মাঠ পর্যায়ে দলের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মানতে কেন্দ্র থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। কোন কাজ হয় নি। অনেক প্রেক্ষাপটে নেতাদের ঢাকায় ডেকে কথা বলা হচ্ছে। এখন আওয়ামী লীগের আগামী কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেই এ বিষয়গুলো নিয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত আসতে পারে। আগামী মঙ্গলবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এ বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
দলের স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, নীলফামারীর ডোমার ও ডিমলা উপজেলায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রথম ধাপেই। নির্বাচনে একাধিক প্রার্থীর ভিড়ে ওই দুই উপজেলায় কঠিন বাস্তবতার মুখে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। ওই উপজেলার নেতা-কর্মীরা এ নিয়ে বেশ বিব্রতবোধ করছেন। উপজেলা দুটিতে চেয়ারম্যান পদে মাঠে রয়েছেন ১২ জন প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে আটজনই আওয়ামী লীগ নেতা।
দলের স্থানীয় নেতারা বলছেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ একাধিক নেতা প্রার্থী হওয়ায় প্রকাশ্যে নির্বাচনের মাঠে নামতে পারছেন না অনেকে। ফলে অনেকে অন্তরালে থেকে সমর্থন জানাচ্ছেন পছন্দের প্রার্থীকে। সেটিও প্রকাশ হওয়ায় ভীত অনেকে।
স্থানীয় দলীয় সূত্র জানিয়েছে, নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন ওই এলাকার স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. আনোয়ারুল আশরাফ দীলিপের বোনের স্বামী শফিকুল ইসলাম। তিনি পলাশ পৌরসভার সাবেক মেয়রও। অপর দিকে প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান জাভেদ হোসেন। যার মধ্যে এলাকার দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে বিভক্তি রয়েছে। যা যে কোন সময় উত্তেজনে সৃষ্টি করতে পারে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি উপজেলায় পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষেই কাজ করছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা। নিজের প্রার্থীদের পাশ করিয়ে আনতে মরিয়া তাদের কেউ কেউ। তাতে বিপাকে পরেছে দলের তৃণমূল। স্থানীয় পর্যায়ে দলের মধ্যে কলহ বিরোধ বেড়েই চলেছে। কোন্দল সংঘাত বাড়ার আশঙ্কা প্রকট হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মোট ১৪ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন চেয়ারম্যান পদে ৫ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৫ জন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪ জন। চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন হাটহাজারী উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এসএম রাশেদুল আলম (উত্তর জেলা আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি), উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন চৌধুরী নোমান, উত্তর জেলার সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ইউনুচ গণি চৌধুরী, দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ নূর খান ও যুগ্ম সম্পাদক ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য জসিম উদ্দীন শাহ। এতে কঠির বাস্তবতায় পরেছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। তারা নিজেরে নেতার পক্ষে কাজ করছেন। অনেকে নির্বাচনী মাঠে কাজ করতে নিচ্ছেন কৌশলী ভূমিকাও।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, জামালপুর সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বিজন কুমার চন্দ, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট হাফিজুর রহমান স্বপন ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল হোসেনের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের এই তিন নেতাকে ঘিরে বিভক্ত তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
আরএম/ টাঙ্গন টাইমস
https://slotbet.online/