দাবদাহে পুড়ছে গোটা দেশ। এরই মধ্যে ফের সতর্কবার্তা বা হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এমন দুঃসহ গরমের পাশাপাশি লোডশেডিংয়ে মুরগি ও গবাদিপশু রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছেন দেশের খামারিরা। গরমের তীব্রতায় সারাদেশের পোলট্রি খামারগুলোতে প্রতিদিন বিপুল
সংখ্যক মুরগি মারা যাচ্ছে। কমেছে ডিমের উৎপাদন। গরুর খামারগুলোতে কমেছে দুধের উৎপাদন। বেড়েছে রোগবালাই ও মৃত্যু। অন্যদিকে খামারিদের কাঁধে চেপেছে বাড়তি ব্যয়ের চাপ। দুর্বিষহ দাবদাহে সবমিলিয়ে এখন দিশাহারা খামারিরা।
প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) জানিয়েছে, চলমান তাপপ্রবাহের ফলে হিটস্ট্রোকের কারণে সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ লাখ মুরগি মারা যাচ্ছে। মারা যাওয়া এই মুরগির আনুমানিক মূল্য ২০ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, তীব্র গরমে ডিম ও মুরগি উৎপাদন ৪ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।
চলমান দাবদাহে প্রায় দেড় হাজার ব্রয়লার মুরগি মারা গিয়েছে দিনাজপুরের বীরগাও উপজেলার পোলট্রি ফার্মের মালিক শাহ আলমের। তিনি বলেন, পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে নতুন করে মুরগি তুলেছিলাম। কিন্তু গরমে সব শেষ। দুই হাজার ব্রয়লারের দেড় হাজারই মরে গেছে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হানকুর গ্রামের আলাউদ্দিন পোলট্রির উদ্যোক্তা আলাউদ্দিন সরকারের তিনটি শেডে ৭ হাজার লেয়ার মুরগি রয়েছে। তিনি জানান, গরমের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার শেডে প্রতিদিনই মুরগি মারা যাচ্ছে। আলাউদ্দিন বলেন, শুরুর দিকে সমস্যা না হলেও গত কয়েক দিনে ২০০টিরও বেশি মুরগি মারা গেছে। বাকিগুলোও গরমে হাঁসফাঁস করছে। আমার খামারে ডিমের উৎপাদনও প্রায় ২০ শতাংশ কমে গেছে। ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি। একই গ্রামের আরেক খামারি ইব্রাহীম পোলট্রির মো. ইব্রাহীম মিয়ারও তাপপ্রবাহের মধ্যে গত কয়েক দিনে ৩২০টি মুরগি মরে গেছে। তিনি বলেন, গত রবিবার একদিনেই ২০০টির বেশি মারা যায়। আজও (গতকাল) দুপুর নাগাদ ৯টি মুরগি মারা গেছে। ফ্যান দিয়ে, পানি ছিটিয়েও কাজ হচ্ছে না। ওষুধ, স্যালাইন সব করছি। তারপরও প্রতিদিন মারা যাচ্ছে।
কুমিল্লা সদরের গলিয়ারার তামান্না পোলট্রি কমপ্লেক্সের উদ্যোক্তা আবু তাহের জানান, গরমে মুরগি মরতে শুরু করলে
তার ৯টি শেডের ১৪ হাজার মুরগির অর্ধেক বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। অবশিষ্ট ৭ হাজারের মধ্যে ২৫০টি মারা গেছে। এখন বাকি মুরগি নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তায় তিনি।
যশোর সদর উপজেলার বীরনারায়ণপুর গ্রামের এমএমজে এগ্রো ফার্মের মালিক মো. মনিরুজ্জামান বলেছেন, তার ফার্মে ২০০ মুরগি আছে। ফার্মে সারাক্ষণ ফ্যান চালিয়ে রাখতে হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের সময় তারা কয়েকজন মিলে হাত পাখা টেনে বাতাস দিয়ে মুরগি বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
বিপিএর সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, সারাদেশের খামারিদের কাছ থেকে মুরগি মারা যাওয়ার তথ্য পাচ্ছি। এটা ভীষণ উদ্বেগের বিষয়। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এর প্রভাব মুরগির বাজারে পড়বে এবং মুরগি ও ডিমের দাম মারাত্মকভাবে বেড়ে যেতে পারে। আমাদের ধারণা গত ১০ থেকে ১২ দিনে সারাদেশে ১০ লাখের বেশি ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালি মুরগি মারা গেছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই ব্রয়লার মুরগি।
তিনি আরও বলেন, এমনিতেই খাবারের দাম ও মুরগির বাচ্চার বাজারে চলমান নৈরাজ্যে খামারিরা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়াই করছেন। এর মধ্যে গরমে মুরগি টিকিয়ে রাখতে প্রতিটি খামারে খরচ লাগামহীনভাবে বেড়ে গেছে। অনেক প্রান্তিক খামারি জানেনই না তীব্র গরমে কি কি করণীয়। আমরা সচেতন করার চেষ্টা করছি।
একদিকে গরম অন্যদিকে দিনভর লোডশেডিং। এর মধ্যে মুরগি টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন কক্সবাজারের রামু উপজেলার খুনিয়াপালং গ্রামের সাঈদি পোলট্রির মো. সাঈদুর রহমান। মুরগি মারা যাওয়ায় বাধ্য হয়ে ৩০ হাজার টাকার জেনারেটর ও ৮ হাজার টাকা খরচ করে শেডের উপর পানির ঝরনা বসিয়েছেন। এর পরও মুরগি মরছে।
চট্টগ্রামের সীতাকুর জাফরনগরে ব্র্যান্ডেড এগ্রো ফার্মের উদ্যোক্তা বাপ্পি কুমারেরও একই দশা। সাতকানিয়া উপজেলার জহির পোলট্রির উদ্যোক্তা মো. জহির উদ্দিন লোকসান ঠেকাতে তার ৫ হাজার মুরগির পুরোটাই বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
এদিকে গরুর খামারগুলোও গরমে কাবু হয়ে পড়েছে। বগুড়ার কাহালু থানার দরগাহাট গ্রামের ‘বগুড়া ভা-ার এগ্রোর’ উদ্যোক্তা তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব বলেন, আমার খামারে ১৬০টি গরু রয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি দুধের গরু। এই গরমে গরুগুলোকে সুস্থ রাখতে হিমশিম খাচ্ছি। দৈনিক দুবারের স্থলে ৪-৫ বার গোসল করাতে হচ্ছে। অপরদিকে গরমের কারণে গরু খাচ্ছে কম। দুধের উৎপাদনও অনেক কমে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক ২০০ লিটার দুধ পেতাম, এখন সেখানে ১৬০ লিটারও হচ্ছে না।
যশোর সদর উপজেলার কাজীপুর গ্রামের গরু খামারি মোসলেম উদ্দীন বলেছেন, তার ফার্মের ১১টি গরুকে ২৪ ঘণ্টা ফ্যান চালিয়ে আর দিন-রাত ৩ বার গোসল করিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
খামারিদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি ইমরান হোসেন বলেন, চলমান তাপপ্রবাহের প্রভাবে খামারগুলোতে দুধের উৎপাদন ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। হিটস্ট্রোকের কারণে গরু মারা যাওয়ার খবর পাইনি। কিন্তু গরমে বাদলাসহ বিভিন্ন রোগ বেড়ে গেছে। এতে গরু মারা যাচ্ছে। চলমান দাবদাহে সহস্রাধিক গরু মারা যাওয়ার তথ্য পেয়েছি। এটা আরও বাড়ছে।
আধুনিক খামারিরা আগেভাগে প্রস্তুতি নিলেও প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের অধিকাংশই জানেন না, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কি করতে হবে। অপরদিকে গরু সুস্থ রাখতে খামারগুলোতে ব্যয় বেড়ে গেছে অন্তত ২০ শতাংশ। তিনি আরও বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে সব জেলায় জানিয়ে দেওয়া হলেও খামারিরা সেভাবে উপকৃত হচ্ছেন না। মানুষের জন্য ২৪ ঘণ্টা সেবা থাকলেও গবাদিপশুর ক্ষেত্রে অফিস কর্মঘণ্টার বাইরে সেবা মেলে না। তাপপ্রবাহের মাঝে খামারিরা সহযোগিতা না পেলে খামার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর প্রভাব কোরবানির পশুর বাজারেও পড়তে পারে।
প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ডা. হেমায়েত উদ্দিনও মনে করেন, চলমান তাপপ্রবাহের কারণে মুরগি ও গবাদিপশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়তে পারে। তিনি বলেন, মুরগির জন্য স্বাভাবিক সহনীয় তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর গরুর ক্ষেত্রে এটা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু সারাদেশে এখন দিনের তাপমাত্রা এর চেয়েও বেশি থাকছে। তাপমাত্রা বেশি থাকায় মুরগির ক্ষেত্রে হিটস্ট্রোক, এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ বেশ কিছু রোগ এবং গরুর লাম্পি, ভেক্টর বর্ন যেসব ডিজিজ ও বাছুরের ক্ষেত্রে বাদলা রোগ বাড়তে পারে। খামারিদের উচিত খামারের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখার ব্যবস্থা করা। গরমের সময় খাবার না দিয়ে দিনের যে সময় কম তাপমাত্রা থাকে তখন খাবার দেওয়া। বদ্ধ জায়গায় না রাখা। শুকনো খাবারের বদলে তাজা খাবার বেশি দেওয়া ও পানি শূন্যতা এড়াতে পর্যাপ্ত পানি খাওয়াতে হবে।
কথা হলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (সম্প্রসারণ) ডা. মো. শাহিনুর আলম বলেন, দাবদাহের মধ্যে খামারে মুরগি ও গবাদিপশু রোগাক্রান্ত হওয়া ও মারা যাওয়ার তথ্য আমাদের কাছেও আসছে। এই সময় মুরগির ক্ষেত্রে বিশেষ করে ব্রয়লারের ক্ষেত্রে হিটস্ট্রোক এবং গবাদিপশুর ক্ষেত্রে ‘ভেক্টর বর্ন ডিজিজ’, ‘ইফিমেরাল ফেভার’ ও ‘লাম্পি’ বাড়তে পারে।
তাপপ্রবাহকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এগুলো মোকাবিলা করতে আমরা কন্ট্রোল রুম খুলে সারাদেশের মাঠপর্যায়ের অফিসগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছি। তারা খামারিদের সহায়তা করছেন। এটা ঠিক যে, ২৪ ঘণ্টা সেবার ব্যবস্থা এখনো হয়নি। তবে ওয়েবসাইটে আমাদের কর্মকর্তাদের ফোন নম্বর রয়েছে, খামারিরা চাইলে আমাদের যেকোনো সময়ে ফোন দিয়ে সহায়তা নিতে পারেন।
আরএম/ টাঙ্গন টাইমস
https://slotbet.online/
I conceive you have remarked some very interesting details, appreciate
it for the post.